ইবরাহীম বিন আদহাম রহ. ইতিহাস বিখ্যাত বুযুর্গ - MB TV

ইবরাহীম বিন আদহাম রহ. ইতিহাস বিখ্যাত বুযুর্গ

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১ | ১২:২৪ 167 ভিউ
ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১ | ১২:২৪ 167 ভিউ
Link Copied!

এমবি টিভি ডেস্ক :

১৬২ হিজরী। ঘন অন্ধকারের মাঝে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপটির তীরে। নির্জন সৈকতে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বাতাসে মিশে আছে সমুদ্রের নোনা গন্ধ। সাগর তীর থেকে একটু দূরে অবস্থিত একটি তাবুতে একজন বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। তার পাশে একত্রিত হয়েছে তার কজন শিষ্য। বৃদ্ধের অবস্থা আশংকাজনক। দিনের বেলা থেকে তার একটানা ডায়রিয়া হচ্ছে। ক্রমেই তার চেহারায় দূর্বলতার চিহ্ন ফুটে উঠছে। দেখে মনে হচ্ছে শেষ সময় উপস্থিত।

 

বিজ্ঞাপন

‘আমার তীর ধনুকগুলো নিয়ে আসো’ কাঁপা কন্ঠে বললেন বৃদ্ধ। তিনি হাত তুলে একটু দূরে রাখা তীর ধনুকের দিকে ইশারা করতে চাইলেন, কিন্তু দূর্বলতার কারণে পারলেন না।

 

একজন শিষ্য দ্রুত গিয়ে তার তীর ধনুক নিয়ে এলো। তীর ধনুক দেখে বৃদ্ধের চেহারা আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। তিনি শক্তহাতে তীর ধনুক আঁকড়ে রইলেন। যেদিকে শত্রুদের শিবির সেদিকে তীর তাক করলেন। অখন্ড নীরবতা নিয়ে কিছু সময় পার হয়। আচমকা উপস্থিতরা লক্ষ্য করলেন, বৃদ্ধের শরীরে প্রানের স্পন্দন নেই। দ্রুত তারা পাশে ছুটে এলেন। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন, বৃদ্ধ ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন।

বিজ্ঞাপন

 

রোম সাগরের ছোট একটি দ্বীপে মৃত্যুবরণকারী এই বৃদ্ধকে সবাই চিনে একজন সুফী বুজুর্গ হিসেবে। তবে তিনি ভন্ড  সুফিদের মত ছিলেন না যারা জিহাদ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে চায়। যারা বলে বেড়ায় জিহাদ সুফিদের জন্য নয়। যারা ইনিয়ে বিনিয়ে নানা শব্দে ও বাক্যে মূলত জিহাদকেই অস্বীকার করতে চায়। এই বৃদ্ধ মানুষটি অন্য সকল ইবাদতের মত জিহাদের মহান ইবাদতেও শরিক হয়েছিলেন। তিনি সীমান্ত এলাকা পাহারা দিতেন। যাকে বলা হয় রিবাত। রিবাতের ইবাদত অনেক বড় ইবাদত। হাদিসে এই ইবাদতের জন্য অনেক সুসংবাদ ও পুরস্কারের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পথে একদিন রিবাত করা দুনিয়া ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সব থেকে উত্তম। (বুখারি, ২৮৯২)

 

জীবনের শেষদিনগুলিতে বৃদ্ধ মানুষটি রোম সাগরের একটি দ্বীপে অবস্থান করছিলেন। সে সময় তিনি দ্বীপ থেকে শত্রুদের গতিবিধি নজরে রাখতেন। এখানেই তিনি অসুস্থ হন ও মৃত্যুবরণ করেন।

 

বৃদ্ধ এই মানুষটিকে ইতিহাস আজো স্মরণ করে ইবরাহিম বিন আদহাম নামে।

 

ইবরাহিম বিন আদহামের জন্ম খোরাসানের অন্তর্গত বলখ শহরে। জীবনের শুরুর দিনগুলি তিনি কাটিয়েছেন এখানেই। পরে তিনি দামেশকে চলে আসেন।

 

ইবরাহিম বিন আদহাম ছিলেন এক বনেদী পরিবারের সন্তান। ঐতিহাসিক আবু নুয়াইম লিখেছেন, তিনি ছিলেন বাদশাহের পরিবারের সন্তান। যৌবনে তিনি শিকার করা পছন্দ করতেন। একদিন তিনি শিকারে বের হন। তিনি একটি শেয়ালকে ধাওয়া করছিলেন। এ সময় অদৃশ্য থেকে শব্দ এলো তোমাকে এই কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। এই কাজ করার আদেশও তোমাকে দেয়া হয়নি। এই শব্দ শুনে ইবরাহিম বিন আদহাম হতবিহবল হয়ে পড়েন। কিছুক্ষন পর নিজেকে সামলে তিনি বলতে থাকেন, রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ভীতি প্রদর্শনকারী এসেছেন। এরপর তিনি নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যান। কিছুদিন পর তিনি সিরিয়া চলে যান। সেখানে হালাল রিজিকের সন্ধান করেন। এ সময় তিন্নি লোকজনের বাগানে কাজ করতেন। একজন শ্রমিক হিসেবে বাগান দেখভাল করতেন তিনি। বাগানের লোকজনের সাথে বসে একত্রে খাবার খেতেন।

 

বিভিন্ন বর্ননা থেকে বুঝা যায় কিছুদিন তিনি ইলম অর্জন করেছেন। বিশেষ করে হজরত আবু হুরাইরা (রা) এর ছাত্র মুহাম্মদ বিন যিয়াদ আল জুমাহি থেকে তিনি হাদিস বর্ননা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে পাঠদানের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করেননি।

 

তিনি খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি তার দোয়ায় বলতেন, হে আল্লাহ আপনি আমাকে আপনার মুসিবতের লাঞ্চনা থেকে আপনার আনুগত্যের সম্মানের দিকে স্থানান্তরিত করুন। একদিন তাকে বলা হলো, গোশতের দাম বেড়ে গেছে। তিনি বললেন, এটা কেনা দরকার নেই, কদিন পর এমনিতেই দাম কমে যাবে। কারণ যে জিনিসের প্রতি মানুষ আগ্রহ দেখায় না, তার দাম কমে যায়।

 

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাথে ইবরাহিম বিন আদহামের দেখা সাক্ষাত হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক তার প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, ইবরাহিম একজন অসাধারণ গুনী মানুষ। তার সাথে আল্লাহর সাথে রয়েছে অনেক রহস্য। আমি কোনোদিন তাকে প্রকাশ্যে তাসবিহ পড়তে বা অন্য কোনো ইবাদত করতে দেখিনি। অর্থাৎ নফল ইবাদত তিনি লোকজন থেকে লুকিয়ে করতেন।

 

এক ব্যক্তি একটি জুব্বা নিয়ে এসেছিল ইবরাহিম বিন আদহামের কাছে। সে বললো, আপনার জন্য এই জুব্বা এনেছি। আমার ইচ্ছা আপনি এটি গ্রহন করুন। ইবরাহিম বললেন, আমি গ্রহন করবো তবে আমার কিছু শর্ত আছে। যদি তুমি ধনী হও তাহলে গ্রহন করবো। দরিদ্র হলে গ্রহন করবো না। লোকটি বললো, তাহলে গ্রহন করুন। আমি ধনী। ইবরাহিম প্রশ্ন করলেন, তোমার কাছে কী পরিমান অর্থ আছে? লোকটি বললো, দুই হাজার দিরহাম। ইবরাহিম বললেন, তুমি কি চাও তোমার চার হাজার দিরহাম হোক? লোকটি বললো, হ্যা চাই। ইবরাহিম বললেন, তাহলে তোমার জামা তুমি ফিরিয়ে নাও। কারণ তুমি দরিদ্র।

 

একদিন এক ব্যক্তি এসে ইবরাহিমের সাথে দেখা করে। সে বলে, আপনার পিতা মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তিনি অনেক সম্পদ রেখে গেছেন। সেগুলোর মালিক এখন আপনি। একথা শুনে ইবরাহিম বলখে গিয়ে সেখানকার কাজির সাথে দেখা করে নিজের সম্পদ বুঝে নেন এবং সকল সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। তিনি আবার আগের মত অভাবের দিন যাপন শুরু করেন।

 

তার কাছে নানা শ্রেনীর লোকজন নিয়মিত আসতো। তিনি তাদেরকে নসিহাহ দিতেন কিন্তু কখনো তাদের দ্বারা নিজের কোনো স্বার্থ উদ্ধার করতেন না। লোকজনের হাদিয়া গ্রহন করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন খুব সতর্ক। প্রায় অভাবে, অর্ধাহারে, অনাহারে থাকতেন কিন্তু কখনো কারো কাছে নিজের অভাবের কথা জানাতেন না। একবার তার কাছে একটি শক্ত রুটি ছিল। এটির সাথে খাবার মত আর কিছু ছিল না তার সাথে। তিনি জর্দান নদীর পানিতে এই রুটি চুবিয়ে নরম করে নিলেন। তারপর তা খেলেন।

 

ইবরাহিম বিন আদহাম একবার ইমাম আউযায়িকে দাওয়াত করেন। সেদিন তিনি অনেক খাবারের আয়োজন করেছিলেন। ইমাম আউযায়ি বলেন, আপনার কি মনে হয় না এই আয়োজন সীমালঙ্ঘন হচ্ছে? ইবরাহিম বিন আদহাম বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি তার ভাইয়ের জন্য খরচ করে তাহলে এটা তার দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।

 

একজন আমীর একবার ইবরাহিমকে প্রশ্ন করেছিল, তোমার জীবিকা কীভাবে আসে? ইবরাহিম জবাবে বললেন, আমরা দুনিয়াকে পিছনে রেখে আমাদের দ্বীনকে জোড়া লাগাচ্ছি। দুনিয়া হারিয়ে যাবে, টিকে থাকবে আমাদের দ্বীন।

 

একবার এক ব্যক্তি এসে বললো, আমার অনেক সন্তান, তাই খুব অভাবে আছি। ইবরাহিম বললেন, তোমার যে সন্তানের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ নেননি, তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। এ কথা শুনে সেই ব্যক্তি চুপ হয়ে যায়।

 

বাকিয়্যা বিন ওয়ালিদ বলেন, একবার আমরা ইবরাহিম বিন আদহামের সাথে নৌপথে সফর করছিলাম। এ সময় ঝড় উঠলে নৌকা দুলতে থাকে। আমরা সবাই কান্না করতে থাকি। আমরা বলি, হে আবু ইসহাক আপনি কী দেখছেন? তখন ইবরাহিম বিন আদহাম বলেন, ইয়া হাইয়্যু, আপনি জীবিত ছিলেন যখন কেউ জীবিত ছিল না। সকল জীবিতের আগেও আপনি ছিলেন, সবার পরেও আপনি থাকবেন। ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুম। আমরা আপনার কুদরত দেখেছি, এবার আপনার দয়া ও ক্ষমা দেখান। এই দোয়ার পরেই ঝড় থেমে যায়।

 

ইবরাহিম বিন আদহাম রাতের বেলা ঘুমাতেন কম। এই সময়টায় তিনি ইবাদত করতেন অথবা দ্বীনি বিষয়ে চিন্তা করতেন।

 

যতদিন তিনি এখানে ছিলেন একজন মুসাফিরের মতই ছিলেন। ধন সম্পদ অর্জনের দিকে নিজেকে ব্যস্ত না করে নিজের সময় ব্যয় করেছিলেন পরকালের সঞ্চয় জমা করার কাজে। নশ্বর দুনিয়া ও চিরস্থায়ী আখিরাত যখন সামনাসামনি হয়েছিল তিনি তখন আখিরাতকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দুনিয়ার হাতছানিকে পিছনে ফেলেছেন, সাড়া দেননি দুনিয়ার মন ভোলানে আহবানে। এটিই ছিল তার সাফল্য। তার জীবন থেকে আমাদের নেয়ার মত পাথেয় এটিই। আল্লাহ আমাদেরকে তার জীবন থেকে কিছু আলো নিয়ে আলোকিত হওয়ার তাওফিক দিক। আমিন।

 

(সিয়ারু আলামিন নুবালা ও আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া থেকে সংক্ষেপিত)